ঢাকা ১২:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার

  • আপডেট সময় : ০৩:২৯:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৯ বার পড়া হয়েছে

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এই চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে আশা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কার্যালয়।

চারটি মামলার একটি হলো মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূল করা। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক।

আমলে নেওয়া অন্য তিনটি মামলা হলো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা ও আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলা।

চার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি ৫৭ জন। তাদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ১৬ জন। সেই ১৬ জনসহ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর এখন পর্যন্ত মোট অভিযোগ এসেছে ৪৬৩টি। এর মধ্যে ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ৮৪ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত আর বাকিরা পলাতক।

মামলা ও বিচারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শহীদদের পরিবার, শহীদদের স্বজন, ভিকটিমদের আবেগ যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, তাদের বিচারের যে দাবি, যে তৃষ্ণা, সেটা যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, একইভাবে আইন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড, আসামির অধিকার এগুলোকেও মেইনটেন করেই এটা করতে হয়। সেটা করতে যে যুক্তিসঙ্গত সময় দরকার, সেটা আমরা নিয়েছি, সেটা আমরা নিচ্ছি।’

তাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইল কোর্টের যেটা করা সম্ভব, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের পক্ষে সেই ধরনের বিচার সম্ভব নয়। এটার নির্দিষ্ট প্রসিডিউর আছে। সেই প্রসিডিউর ফলো করতে হয়। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। নভেম্বর পর্যন্ত কোর্ট সবকিছু ঠিকঠাক হতে সময় লেগেছে। তারপরে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে, ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রথম তদন্ত রিপোর্ট তদন্ত সংস্থা দিতে পেরেছেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ মুহূর্তে চারটা মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। অনেকেই বলছেন, বিচার দৃশ্যমান দেখি না। বিচার দৃশ্যমান। চারটা মামলার ওপেন বিচার চলছে। আমরা লাইভ সম্প্রচার করেছি কিছু কিছু অংশ। ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায়। এ মামলা প্রমাণ করতে গিয়ে শহীদদের যে ভিডিও দেখেছি, তাদের প্রচণ্ড একটা দাবি আছে। সেটা হলো পারলে এখনই ফাঁসি দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যখন বিচার করতে যাব আমাদের আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশের বাইরে বিশ্বব্যাপী একটা অডিয়েন্স আছে, যারা স্ক্যানার দিয়ে প্রতি মিনিটে স্ক্যান করে যে আমাদের বিচারটা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না।’

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে আসা খুন ও গুমের অভিযোগে করা মামলা ও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য গাজী মনোয়ার হোসাইন (এমএইচ) তামিম জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো সময়ের তুলনায় গত এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গিয়েছিল ১৮ মাসে। আর গড়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সময় ছিল আড়াই বছর থেকে তিন বছর। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর প্রথম ছয় মাসে পাঁচটি তদন্ত প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যায়ে।

গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে কোনো একটি ঘটনার তদন্ত করলে এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ না। সারাদেশে প্রত্যেকটি ঘটনার একটি চিত্র তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) তার প্রতিবেদনে তুলে আনেন। সেই চিত্র বা সেই অপরাধেরই একটি অংশ কোনো একটি ঘটনার জন্য তদন্ত করে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হয়। যখনই দেখা যায় ওই ঘটনাটি সিস্টেমেটিক অন্যান্য ঘটনারই একটি অংশ তা হলেই কেবল এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। যে কারণে এই তদন্তটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। যদি শুধু একটি ঘটনার তদন্ত করা হয় তা হলে সেটি সাধারণ আইনে বিচার। তারপর প্রত্যেকটি মামলায় একটি পটভূমি তৈরি করি, ওই পটভূমিতে এ মামলার ঘটনার বাইরে আর কোথায় কী কী ঘটনা ঘটেছে সব বর্ণনা দিতে হয়।’

এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যেটা হয়েছে সেটা হলো সাধারণ মার্ডার থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ। একজন মানুষ খুন করে, সেটা অনুসন্ধান করে। আর এখানে দেড় হাজার লোক খুন হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হয়নি। ফ্যামিলি মেম্বারদের খবর দেওয়ার সুযোগ তারা দেয়নি। বলেছে, কেউ যদি নিয়ে যাওয়ার মতো থাকে নিয়ে যাক। অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ হিসেবে দাফন করে ফেলতে হবে। সেখানে শহীদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের রাতে মানুষের অজান্তে কবর দিতে হয়েছে। তাই এসব মামলার তদন্ত অত্যন্ত জটিল।

অন্য প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, পটভূমি ও ইতিহাস বিষয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা লাগে। মামলায় প্রমাণের জন্য সাধারণ সাক্ষী তো লাগেই। যার কারণে এই মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। সেই তুলনায় আমাদের তদন্ত সংস্থা অতি অল্প সময়ে যুক্তিসঙ্গত সময়েই তাদের তদন্ত সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ বিষয়ে আমরা মনে করি তদন্ত সংস্থা সন্তোষজনক কাজ করেছে।

গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আমরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। তাই দিনের পর দিন একটার পর একটা দাবিতে রাস্তা অবরোধ ও মানববন্ধন করা হতো। মাসের পর মাস এরকম আন্দোলন চলায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তার মধ্যে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই মামলা ও অভিযোগ নিয়ে। সে কারণে প্রথমদিকে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসহযোগিতা বা কম সহযোগিতা পেয়েছি। পরে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে এসব অসহযোগিতা রিমুভ হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ সহায়তা পাচ্ছি।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি বিবিধ মামলা প্রি-ট্রায়াল স্টেজে আছে। এই ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়ে ৮৪ জন কারাগারে।

source : jago

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার

আপডেট সময় : ০৩:২৯:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এই চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে আশা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কার্যালয়।

চারটি মামলার একটি হলো মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূল করা। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক।

আমলে নেওয়া অন্য তিনটি মামলা হলো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা ও আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলা।

চার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি ৫৭ জন। তাদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ১৬ জন। সেই ১৬ জনসহ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর এখন পর্যন্ত মোট অভিযোগ এসেছে ৪৬৩টি। এর মধ্যে ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ৮৪ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত আর বাকিরা পলাতক।

মামলা ও বিচারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শহীদদের পরিবার, শহীদদের স্বজন, ভিকটিমদের আবেগ যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, তাদের বিচারের যে দাবি, যে তৃষ্ণা, সেটা যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, একইভাবে আইন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড, আসামির অধিকার এগুলোকেও মেইনটেন করেই এটা করতে হয়। সেটা করতে যে যুক্তিসঙ্গত সময় দরকার, সেটা আমরা নিয়েছি, সেটা আমরা নিচ্ছি।’

তাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইল কোর্টের যেটা করা সম্ভব, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের পক্ষে সেই ধরনের বিচার সম্ভব নয়। এটার নির্দিষ্ট প্রসিডিউর আছে। সেই প্রসিডিউর ফলো করতে হয়। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। নভেম্বর পর্যন্ত কোর্ট সবকিছু ঠিকঠাক হতে সময় লেগেছে। তারপরে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে, ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রথম তদন্ত রিপোর্ট তদন্ত সংস্থা দিতে পেরেছেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ মুহূর্তে চারটা মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। অনেকেই বলছেন, বিচার দৃশ্যমান দেখি না। বিচার দৃশ্যমান। চারটা মামলার ওপেন বিচার চলছে। আমরা লাইভ সম্প্রচার করেছি কিছু কিছু অংশ। ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায়। এ মামলা প্রমাণ করতে গিয়ে শহীদদের যে ভিডিও দেখেছি, তাদের প্রচণ্ড একটা দাবি আছে। সেটা হলো পারলে এখনই ফাঁসি দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যখন বিচার করতে যাব আমাদের আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশের বাইরে বিশ্বব্যাপী একটা অডিয়েন্স আছে, যারা স্ক্যানার দিয়ে প্রতি মিনিটে স্ক্যান করে যে আমাদের বিচারটা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না।’

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে আসা খুন ও গুমের অভিযোগে করা মামলা ও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য গাজী মনোয়ার হোসাইন (এমএইচ) তামিম জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো সময়ের তুলনায় গত এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গিয়েছিল ১৮ মাসে। আর গড়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সময় ছিল আড়াই বছর থেকে তিন বছর। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর প্রথম ছয় মাসে পাঁচটি তদন্ত প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যায়ে।

গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে কোনো একটি ঘটনার তদন্ত করলে এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ না। সারাদেশে প্রত্যেকটি ঘটনার একটি চিত্র তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) তার প্রতিবেদনে তুলে আনেন। সেই চিত্র বা সেই অপরাধেরই একটি অংশ কোনো একটি ঘটনার জন্য তদন্ত করে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হয়। যখনই দেখা যায় ওই ঘটনাটি সিস্টেমেটিক অন্যান্য ঘটনারই একটি অংশ তা হলেই কেবল এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। যে কারণে এই তদন্তটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। যদি শুধু একটি ঘটনার তদন্ত করা হয় তা হলে সেটি সাধারণ আইনে বিচার। তারপর প্রত্যেকটি মামলায় একটি পটভূমি তৈরি করি, ওই পটভূমিতে এ মামলার ঘটনার বাইরে আর কোথায় কী কী ঘটনা ঘটেছে সব বর্ণনা দিতে হয়।’

এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যেটা হয়েছে সেটা হলো সাধারণ মার্ডার থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ। একজন মানুষ খুন করে, সেটা অনুসন্ধান করে। আর এখানে দেড় হাজার লোক খুন হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হয়নি। ফ্যামিলি মেম্বারদের খবর দেওয়ার সুযোগ তারা দেয়নি। বলেছে, কেউ যদি নিয়ে যাওয়ার মতো থাকে নিয়ে যাক। অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ হিসেবে দাফন করে ফেলতে হবে। সেখানে শহীদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের রাতে মানুষের অজান্তে কবর দিতে হয়েছে। তাই এসব মামলার তদন্ত অত্যন্ত জটিল।

অন্য প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, পটভূমি ও ইতিহাস বিষয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা লাগে। মামলায় প্রমাণের জন্য সাধারণ সাক্ষী তো লাগেই। যার কারণে এই মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। সেই তুলনায় আমাদের তদন্ত সংস্থা অতি অল্প সময়ে যুক্তিসঙ্গত সময়েই তাদের তদন্ত সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ বিষয়ে আমরা মনে করি তদন্ত সংস্থা সন্তোষজনক কাজ করেছে।

গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আমরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। তাই দিনের পর দিন একটার পর একটা দাবিতে রাস্তা অবরোধ ও মানববন্ধন করা হতো। মাসের পর মাস এরকম আন্দোলন চলায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তার মধ্যে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই মামলা ও অভিযোগ নিয়ে। সে কারণে প্রথমদিকে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসহযোগিতা বা কম সহযোগিতা পেয়েছি। পরে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে এসব অসহযোগিতা রিমুভ হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ সহায়তা পাচ্ছি।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি বিবিধ মামলা প্রি-ট্রায়াল স্টেজে আছে। এই ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়ে ৮৪ জন কারাগারে।

source : jago