যে কারণে নিকলী হাওরে বর্ষা একেবারেই অন্য রকম

- আপডেট সময় : ০৫:১১:১৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫
- / ২৮ বার পড়া হয়েছে
ঢাকায় আমরা কয়েজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ‘ব্রেকফাস্ট আড্ডা’ দিয়ে থাকি। খেতে খেতে পর্যটক, ভ্রমণ লেখকসহ নানা অঙ্গনের মানুষের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ হয়। এই আড্ডা–আয়োজনের নিয়মিত কয়েকজন গিয়েছিলাম নিকলীতে। প্রথম দিন গিয়ে উঠি কটিয়াদীর জালালপুর ইকো রিসোর্টে।
দ্বিতীয় দিনে আমাদের প্রধান গন্তব্য নিকলী হাওর। ঘুম থেকে উঠেই দেখেছি টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, মনে হলো আকাশ আমাদের হাওর দর্শনের বাসনায় জল ঢেলে দিচ্ছে। দলে সংশয় দেখা দিল, এই বৃষ্টিতে হাওরে যাব, নাকি শুয়ে-বসে এই আরামপ্রদ ও আনন্দদায়ক রিসোর্টেই কাটিয়ে দেব সারা দিন। হাওরে যাওয়ার পক্ষে আমি সবচেয়ে সোচ্চার, ডালিয়াও তা–ই। মাহমুদ হাফিজ বলেন, ‘বৃষ্টি যদি পড়তেই থাকে, হাওরে গিয়েই দেখব।’
কটিয়াদী থেকে সোজা উত্তরে চলে গেছে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ সড়ক। পুলের ঘাট থেকে পুবে চলে গেছে সড়ক। সরু সড়কটি গোড়ার দিকে ভাঙাচোরা হলেও পরবর্তী কুড়ি কিলোমিটার সুন্দর পিচঢালা। পথে বনগ্রাম বাজারে সরগরম মাছের বাজার। এসব মাছ, বলার অপেক্ষা রাখে না হাওরের। আরও এগোতে দেখি, জলের রাজ্য। কারও কারও বিভ্রম হলো, বোধ করি নিকলী হাওরের পিঠ দেখতে পাচ্ছি। নিকলী তখনো ১০ কিলোমিটার।
অবশেষে একটি বেড়িবাঁধের ওপর এসে পড়ি। সামনে জলের এক সমুদ্র। বুঝতে দেরি হয় না, এটিই সেই হাওর। তবে তখনো নিকলী কয়েক কিলোমিটার। বাঁধরাস্তার ওপরেই এই হাওরবর্তী উপজেলা। বাঁধরাস্তাটি ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে চলে গেছে আরও দূরে। শেষ প্রান্তে সেটি আর পথ খুঁজে পায়নি, সেখানেই ১৪–১৫টি নৌকা ঘাটে বাঁধা, সেগুলোর একটি আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ।
নীল রঙের নৌকাটি আমাদের পছন্দ হলো। ইঞ্জিন লাগানো চওড়া নৌকাটির ছাদে গিয়ে চড়ে বসি সবাই। কিছুক্ষণের ভেতর আমরা চলে আসি হাওরের কিছুটা ভেতরে, তাকে কেন্দ্র বলার কোনো জো নেই। কেননা, এই বিপুল জলরাশির কোনো কেন্দ্র নেই। এখানে আকাশ আর জল এমন এক বিশালতা তৈরি করেছে যে নিজের ক্ষুদ্রতা ধুয়েমুছে যায়, উপলব্ধি হয় বিশালত্বের।
আমার ধারণা ছিল হাওর হবে শান্ত; কিন্তু নিকলী হাওরে এসে দেখি, নদীর মতো ঢেউ। মাহমুদ হাফিজ গুগল দেখে জানালেন, নিচেই বয়ে চলেছে এক নদী, নাম—ঘোড়াউত্রা। নাম কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আঁকাবাঁকা নদীটি হাওরের বিশাল জলরাশির মধে৵ হারিয়ে গেছে।
দূরে একটি দ্বীপ চোখে পড়ে। নাম ছাতিয়ার চর। নিকলী হাওরকে কখনো কখনো ‘নিকলীছাতিয়া’ হিসেবে দেখায় গুগল। আমাদের ইচ্ছা সেই চরে যাই। মাঝিরা উৎসাহী না। অনেক সময় লাগবে বলে আমাদের নিবৃত্ত করে। নৌকা চলে সোজা—সেদিকে মিঠামইন, হাওর সেদিকেও আছে। বস্তুত কিশোরগঞ্জের বিশাল এলাকাই বর্ষাকালে হাওর হয়ে যায়।
হাওরে এলে বোঝা যায় পৃথিবী কী নিখুঁত গোলাকার! আমরা কখনো হাওরের ছবি তুলি, কখনো নিজেদের। একবার আমি ও মাহমুদ হাফিজ হামাগুড়ি দিয়ে নৌকার ছইয়ের নিচে ঢুকি। নিচু ছাদ আর বাঁশের পাটাতনের ভেতরে একটাই স্বস্তি—স্মার্টফোনের পর্দা দেখা যায়। বাইরে আলো এত বেশি যে মুঠোফোনের স্ক্রিনে কিছুই দেখা যায় না। তার কারণ অবশ্য এই না যে আকাশে সূর্য প্রখর হয়ে জ্বলছে। বস্তুত সেই প্রভাতের বৃষ্টি থেমে গিয়ে প্রকৃতি হয়েছে মোলায়েম, ছায়াময় ও মনোরম।
হাওরের বিশালতা আর জলের শীতলতা নিয়ে বাতাস বইছিল। দিগন্তরেখার কাছে আকাশ হালকা নীলাভ, বাকিটা জুড়ে পুঞ্জীভূত সাদা মেঘের সমাবেশ। সেসব ভেদ করে অনেকক্ষণ সূর্য কোনো দাপটই দেখাতে পারেনি। সমগ্র নিকলী জুড়ে ছিল অপার স্নিগ্ধতা ও নরম আলোর পরিবেশ।