ঢাকা ১০:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
“বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে ঐকমত্য কমিশন” রক্তের সিঁড়ি তৈরি হয়েছে ১৬ বছরের আন্দোলনে : সালাহউদ্দিন আহমদ গাজা দখলের বিরুদ্ধে ইসরায়েলে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, সৈন্যদের যুদ্ধে না যাওয়ার আহ্বান তুষারের ‘নগ্ন ভিডিও’ ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি নীলার ট্রাম্পের ১৫ হাজার ডলারের ভিসা বন্ড কর্মসূচি, নিশানায় কারা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দুর্নীতি প্রশ্রয় দিতেন না : দুদক চেয়ারম্যান জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, ভোট ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তির আগেই ‘কুলি’র আয় ২৫০ কোটি প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে স্বাক্ষর হতে পারে ৫ সমঝোতা স্মারক ২০৩০ সালে আইডিয়াই হবে মূল চালিকা শক্তি: স্যাম অল্টম্যান

এক মাসে যান্ত্রিক ত্রুটি বিমানের ১৬ উড়োজাহাজে

মোঃ মাজহারুল ইসলাম
  • আপডেট সময় : ০১:৪৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৭ বার পড়া হয়েছে

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ নষ্ট বা কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে নেওয়া হয় হ্যাঙ্গারে। সেখানে মেরামত শেষে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মেরামত শেষে আকাশে ওড়ার পর বিমানে ধরা পড়ছে নানা ধরনের ত্রুটি। এতে গন্তব্যে না গিয়ে ফেরত আসতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ফ্লাইট শিডিউলে। নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না যাত্রীরা। দেশি-বিদেশি বিমানবন্দরে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। এসব কারণে বিমানে নিয়মিত ভ্রমণকারীরা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অন্য এয়ারলাইন্স বেছে নিচ্ছেন। ফলে যাত্রী হারানোর পাশাপাশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষ। ফ্লাইট পরিচালনায় দায়িত্বশীলদের অব্যবস্থাপনা আর গাফিলতির কারণে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটিতে পথ হারিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান। এতে লাভের বদলে বিমানের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।

জানা গেছে, গত এক মাসে আকাশে ওড়ার পর বিমানের অন্তত ১৬টি উড়োজাহাজে ত্রুটি ধরা পড়ে। রহস্য উদ্ঘাটনে কর্তৃপক্ষ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সমাধানে আসতে পারছে না। অভিযোগ উঠেছে, হ্যাঙ্গারে কর্মরত প্রকৌশলীরা দায়সারা কাজ করছেন।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থা (ল্যাভেটরি ফ্লাশিং সিস্টেম) অকেজো থাকায় ঢাকা থেকে আবুধাবিগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি ৩২৭ এক ঘণ্টা উড়ে মাঝ আকাশ থেকে ফিরে আসে।

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার ২৪ জানায়, উড্ডয়নের সময়ই বিমানের সব পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা অচল ছিল। মেলবোর্ন (এমইএল) প্রক্রিয়া অনুসারে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হলেও দীর্ঘ আন্তর্জাতিক রুটে এ অবস্থায় যাত্রা সম্ভব নয় বলে পাইলট ও ক্রুরা আবার ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক আল মাসুদ খান জানান, ফেরত আসা উড়োজাহাজটির ত্রুটি সারানো হয়েছে। ফ্লাইটের যাত্রীদের অন?্য উড়োজাহাজে আবুধাবি পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, একের পর এক বিমান ত্রুটি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রকৌশল বিভাগকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান দীর্ঘ দুই মাস যাবৎ হাঙ্গেরিতে আছেন। বিমানের একের পর এক ত্রুটি ধরা পড়ছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে উদাসীন। এটা নিয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তিনি দাবি করেন, বিমানের কোনো কর্মকর্তা বিদেশে অবস্থান করলে ঘণ্টাপ্রতি ৩০-৪০ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের খরচ বিমান কর্তৃপক্ষ বহন করে। এই ডলারের লোভে তিনি নিজ দায়িত্ব ফেলে রেখে বিদেশে অবস্থান করছেন।

এর আগে গত বুধবার আকাশে বিমানের এক ফ্লাইটে ত্রুটি ধরা পড়ে। দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে ফ্লাইটটি ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায়। মিয়ানমারের আকাশে প্রবেশের পর উড়োজাহাজটির এক ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক কম্পনের সংকেত পান পাইলট। নিরাপত্তা বিবেচনায় দুপুর ১টা ২১ মিনিটে উড়োজাহাজটি ফেরত এসে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এতে ১৬টি ফ্লাইটের শিডিউল এলোমেলো হয়ে পড়ে। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন বয়স্ক, অসুস্থ, শিশু ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যের যাত্রী।

এভিয়েশন বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনার মূলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রকৌশল বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের অবহেলা এবং দায়সারা দায়িত্ব পালন। অভিযোগ রয়েছে, এ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা প্রকৃত কারিগরি জ্ঞান ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া নিয়মিত প্রশিক্ষণের আওতায় না আনা এবং অভ্যন্তরীণ তদারকির ঘাটতিও বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশ বিমানসহ সব কটি উড়োজাহাজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আকাশ পথ থেকে কেন ফ্লাইট ফেরত আসছে, সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে গত ২৮ জুলাই দাম্মামগামী বিমানের বিজি-৩৪৯ ফ্লাইটটিও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঢাকায় ফিরে এসেছিল। আর গত ১৬ জুলাই রাতে দুবাই বিমানবন্দরে বিমানের একটি বোয়িং উড়োজাহাজের চাকা ফেটে গিয়ে ফ্লাইট বিঘিœত হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন ফ্লাইটের ২২০ যাত্রী। এর কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে উড়ে গিয়ে জেদ্দায় অবতরণের পর পার্কিং করতে গিয়ে বিমানের একটি বোয়িংয়ের ৭ নম্বর চাকায় ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে উড়োজাহাজটিকে সেখানেই গ্রাউন্ডেড করা হয়। এতে বিপাকে পড়েন ফ্লাইটটির ৩৮২ যাত্রী।

গত বুধবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়া বোয়িংয়ের উড়োজাহাজটি প্রায় আট মাস ধরে হ্যাঙ্গারে রেখে মেরামত করা হয়। শেষে আকাশে ওড়ানোর পরই দেখা দেয় ত্রুটি। অথচ মেরামতের পর যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা ছাড়াই সেটিকে প্রস্তুত ঘোষণা করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ফল। উড়োজাহাজগুলো নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় ছোট ছোট সমস্যা বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে।

এদিকে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যে কোনো উড়োজাহাজ ওড়ানোর আগে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা আরোপের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুর্ভোগের শিকার হওয়া শাকির আহমেদ নামে এক বিমানযাত্রী জানান, তার ফ্লাইট ছিল বিকাল ৫টায়। একপর্যায়ে জানানো হয় যান্ত্রিক সমস্যার কারণে দেরি হবে। এরপর রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আপডেট দিচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় তার খুব কষ্ট হয়েছে।

বিমানের নিয়মিত ভ্রমণকারী একাধিক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির মতো গুরুতর বিষয়কে হাল্কাভাবে নেওয়া হচ্ছে। উড়োজাহাজ আকাশে উড়বে, সেটি ঠিকঠাক কিনা, আগে নিশ্চিত হতে হবে। এখানে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটগুলোর অবস্থাও বেশি খারাপ। ব্যাংককগামী বিজি৩৮৮ ফ্লাইটটি যান্ত্রিক ত্রুটি ও ডাইভার্সনের কারণে ৬ ঘণ্টা ৩১ মিনিট বিলম্ব হয়। আবার দোহাগামী বিজি১২৫ ফ্লাইট ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট পিছিয়ে যায়। ফ্লাইট বিলম্বের মধ্যে একটি অংশ ছিল ইঞ্জিন প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হওয়া, আরেকটি অংশ ছিল ট্রাফিক সমস্যা। এ ছাড়া মদিনাগামী বিজি২৩৭ ফ্লাইট ৩৫ মিনিট, জেদ্দাগামী বিজি১৩৫ ফ্লাইট ১৫ মিনিট, শারজাগামী বিজি১৫১ ফ্লাইট ৫ মিনিট, বিজি-৬১৫ (চট্টগ্রাম) ফ্লাইট ৪৫ মিনিট, বিজি৬০৩ (সিলেট) ৪২ মিনিট এবং বিজি৪৯৩ (সৈয়দপুর) ফ্লাইট ৪০ মিনিট বিলম্বে ছেড়ে যায়। এ নিয়ে বেশির ভাগ যাত্রীই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে কথা হয় সাবেক এক বৈমানিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিমান ওড়ানো অত্যন্ত জটিল ও সংবেদনশীল একটি প্রক্রিয়া। এখানে সামান্য গাফিলতিই প্রাণহানি হতে পারে। একের পর এক ঘটনায় এখন সময় এসেছে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ পুরো ব্যবস্থাপনাকে পুনর্গঠন করার। যোগ্য প্রকৌশলী নিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সর্বোপরি, জবাবদিহিতামূলক পরিবেশই হতে পারে নিরাপদ আকাশপথের প্রথম পদক্ষেপ।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

এক মাসে যান্ত্রিক ত্রুটি বিমানের ১৬ উড়োজাহাজে

আপডেট সময় : ০১:৪৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ নষ্ট বা কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে নেওয়া হয় হ্যাঙ্গারে। সেখানে মেরামত শেষে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মেরামত শেষে আকাশে ওড়ার পর বিমানে ধরা পড়ছে নানা ধরনের ত্রুটি। এতে গন্তব্যে না গিয়ে ফেরত আসতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ফ্লাইট শিডিউলে। নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না যাত্রীরা। দেশি-বিদেশি বিমানবন্দরে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। এসব কারণে বিমানে নিয়মিত ভ্রমণকারীরা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অন্য এয়ারলাইন্স বেছে নিচ্ছেন। ফলে যাত্রী হারানোর পাশাপাশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষ। ফ্লাইট পরিচালনায় দায়িত্বশীলদের অব্যবস্থাপনা আর গাফিলতির কারণে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটিতে পথ হারিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান। এতে লাভের বদলে বিমানের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।

জানা গেছে, গত এক মাসে আকাশে ওড়ার পর বিমানের অন্তত ১৬টি উড়োজাহাজে ত্রুটি ধরা পড়ে। রহস্য উদ্ঘাটনে কর্তৃপক্ষ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সমাধানে আসতে পারছে না। অভিযোগ উঠেছে, হ্যাঙ্গারে কর্মরত প্রকৌশলীরা দায়সারা কাজ করছেন।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থা (ল্যাভেটরি ফ্লাশিং সিস্টেম) অকেজো থাকায় ঢাকা থেকে আবুধাবিগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি ৩২৭ এক ঘণ্টা উড়ে মাঝ আকাশ থেকে ফিরে আসে।

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার ২৪ জানায়, উড্ডয়নের সময়ই বিমানের সব পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা অচল ছিল। মেলবোর্ন (এমইএল) প্রক্রিয়া অনুসারে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হলেও দীর্ঘ আন্তর্জাতিক রুটে এ অবস্থায় যাত্রা সম্ভব নয় বলে পাইলট ও ক্রুরা আবার ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক আল মাসুদ খান জানান, ফেরত আসা উড়োজাহাজটির ত্রুটি সারানো হয়েছে। ফ্লাইটের যাত্রীদের অন?্য উড়োজাহাজে আবুধাবি পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, একের পর এক বিমান ত্রুটি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রকৌশল বিভাগকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান দীর্ঘ দুই মাস যাবৎ হাঙ্গেরিতে আছেন। বিমানের একের পর এক ত্রুটি ধরা পড়ছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে উদাসীন। এটা নিয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তিনি দাবি করেন, বিমানের কোনো কর্মকর্তা বিদেশে অবস্থান করলে ঘণ্টাপ্রতি ৩০-৪০ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের খরচ বিমান কর্তৃপক্ষ বহন করে। এই ডলারের লোভে তিনি নিজ দায়িত্ব ফেলে রেখে বিদেশে অবস্থান করছেন।

এর আগে গত বুধবার আকাশে বিমানের এক ফ্লাইটে ত্রুটি ধরা পড়ে। দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে ফ্লাইটটি ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায়। মিয়ানমারের আকাশে প্রবেশের পর উড়োজাহাজটির এক ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক কম্পনের সংকেত পান পাইলট। নিরাপত্তা বিবেচনায় দুপুর ১টা ২১ মিনিটে উড়োজাহাজটি ফেরত এসে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এতে ১৬টি ফ্লাইটের শিডিউল এলোমেলো হয়ে পড়ে। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন বয়স্ক, অসুস্থ, শিশু ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যের যাত্রী।

এভিয়েশন বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনার মূলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রকৌশল বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের অবহেলা এবং দায়সারা দায়িত্ব পালন। অভিযোগ রয়েছে, এ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা প্রকৃত কারিগরি জ্ঞান ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া নিয়মিত প্রশিক্ষণের আওতায় না আনা এবং অভ্যন্তরীণ তদারকির ঘাটতিও বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশ বিমানসহ সব কটি উড়োজাহাজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আকাশ পথ থেকে কেন ফ্লাইট ফেরত আসছে, সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে গত ২৮ জুলাই দাম্মামগামী বিমানের বিজি-৩৪৯ ফ্লাইটটিও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঢাকায় ফিরে এসেছিল। আর গত ১৬ জুলাই রাতে দুবাই বিমানবন্দরে বিমানের একটি বোয়িং উড়োজাহাজের চাকা ফেটে গিয়ে ফ্লাইট বিঘিœত হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন ফ্লাইটের ২২০ যাত্রী। এর কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে উড়ে গিয়ে জেদ্দায় অবতরণের পর পার্কিং করতে গিয়ে বিমানের একটি বোয়িংয়ের ৭ নম্বর চাকায় ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে উড়োজাহাজটিকে সেখানেই গ্রাউন্ডেড করা হয়। এতে বিপাকে পড়েন ফ্লাইটটির ৩৮২ যাত্রী।

গত বুধবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়া বোয়িংয়ের উড়োজাহাজটি প্রায় আট মাস ধরে হ্যাঙ্গারে রেখে মেরামত করা হয়। শেষে আকাশে ওড়ানোর পরই দেখা দেয় ত্রুটি। অথচ মেরামতের পর যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা ছাড়াই সেটিকে প্রস্তুত ঘোষণা করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ফল। উড়োজাহাজগুলো নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় ছোট ছোট সমস্যা বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে।

এদিকে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যে কোনো উড়োজাহাজ ওড়ানোর আগে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা আরোপের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুর্ভোগের শিকার হওয়া শাকির আহমেদ নামে এক বিমানযাত্রী জানান, তার ফ্লাইট ছিল বিকাল ৫টায়। একপর্যায়ে জানানো হয় যান্ত্রিক সমস্যার কারণে দেরি হবে। এরপর রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আপডেট দিচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় তার খুব কষ্ট হয়েছে।

বিমানের নিয়মিত ভ্রমণকারী একাধিক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির মতো গুরুতর বিষয়কে হাল্কাভাবে নেওয়া হচ্ছে। উড়োজাহাজ আকাশে উড়বে, সেটি ঠিকঠাক কিনা, আগে নিশ্চিত হতে হবে। এখানে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটগুলোর অবস্থাও বেশি খারাপ। ব্যাংককগামী বিজি৩৮৮ ফ্লাইটটি যান্ত্রিক ত্রুটি ও ডাইভার্সনের কারণে ৬ ঘণ্টা ৩১ মিনিট বিলম্ব হয়। আবার দোহাগামী বিজি১২৫ ফ্লাইট ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট পিছিয়ে যায়। ফ্লাইট বিলম্বের মধ্যে একটি অংশ ছিল ইঞ্জিন প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হওয়া, আরেকটি অংশ ছিল ট্রাফিক সমস্যা। এ ছাড়া মদিনাগামী বিজি২৩৭ ফ্লাইট ৩৫ মিনিট, জেদ্দাগামী বিজি১৩৫ ফ্লাইট ১৫ মিনিট, শারজাগামী বিজি১৫১ ফ্লাইট ৫ মিনিট, বিজি-৬১৫ (চট্টগ্রাম) ফ্লাইট ৪৫ মিনিট, বিজি৬০৩ (সিলেট) ৪২ মিনিট এবং বিজি৪৯৩ (সৈয়দপুর) ফ্লাইট ৪০ মিনিট বিলম্বে ছেড়ে যায়। এ নিয়ে বেশির ভাগ যাত্রীই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে কথা হয় সাবেক এক বৈমানিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিমান ওড়ানো অত্যন্ত জটিল ও সংবেদনশীল একটি প্রক্রিয়া। এখানে সামান্য গাফিলতিই প্রাণহানি হতে পারে। একের পর এক ঘটনায় এখন সময় এসেছে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ পুরো ব্যবস্থাপনাকে পুনর্গঠন করার। যোগ্য প্রকৌশলী নিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সর্বোপরি, জবাবদিহিতামূলক পরিবেশই হতে পারে নিরাপদ আকাশপথের প্রথম পদক্ষেপ।